‘ড্যান্ডি’তে আসক্ত খুলনার পথশিশুরা
জয়নাল ফরাজীঃ
দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে অবহেলা, অযত্ন আর অনাদরে বেড়ে ওঠা ঠিকানাবিহীন খুলনার হাজার হাজার পথশিশু মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বস্তির অলি-গলিতে ভাসমান শিশুদের মাদক সেবনের দৃশ্য অহরহই দেখা যায়। সারা দিন কাগজ বা অন্যান্য ভাঙ্গারির মালামাল কুড়িয়ে তা সংশ্লিষ্ট দোকানে বিক্রি করে যে টাকা আয় করে, তার প্রায় পুরোটাই তারা ব্যয় করে মাদক সেবনে। অন্যদিকে এই মাদকাসক্ত শিশুরা চুরি, ছিনতাই, খুনসহ নানা রকম অপরাধকর্মেও জড়িয়ে পড়ছে। অথচ তাদের নিরাময়ে বা রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি কেনো জোরালো উদ্যোগ নেই।
এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, নগরীতে বসবাসরত অধিকাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। 
প্রতিদিন সন্ধ্যা ও রাতে খুলনা নগরীর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, সোনাডাঙ্গা ও রূপসা বাস টার্মিনাল এলাকা, বড় বাজার, সাত রাস্তার মোড়, রূপসা, নতুন বাজারের রাস্তায় প্রকাশ্যেই শিশুদের বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন করতে দেখা যায়। 
তবে তারা সবচেয়ে বেশি আসক্ত ড্যান্ডিতে। ড্যান্ডি এক ধরনের আঠা যা মূলত সলিউশন। এতে রয়েছে টলুইন নামে একটি মাদক উপাদান। এটি নিলে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। পলিথিনে মুখ লাগিয়ে শিশুদের ড্যান্ডি সেবন খুবই পরিচিত দৃশ্য। এটি এখন পথশিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় মাদক। বলাই বাহুল্য দীর্ঘমেয়াদের এসব মাদক গ্রহণ এই শিশুদের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। অন্যদিকে তারা তাদের রোজগার মাদকের পেছনে ব্যয় করে আরো অর্থলাভের উপায় হিসেবে চুরি, ছিনতাই, প্রতারণা, এমনকি খুন খারাবির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে শিশু কিশোর অপরাধীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাই এর প্রমাণ।
শিশুদের একটা বড় অংশের এরকম বিপথগামী হওয়া, অক্ষম-অকর্মন্য সামাজিক বোঝা হয়ে বেড়ে ওঠা এবং সামাজিক অপরাদের একটি বড় জাতীয় সমস্যা। অথচ এ নিয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের তেমন কানো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এসব শিশু বেশিরভাগই পরিবার বা অভিভাবকহীন, তাদের দেখাশোনার কেউ নেই। পারিবারিক পরিবেশের অভাব, দারিদ্র্য, নানা রকম বঞ্চনা-দুর্ব্যবহার-নিপীড়নের শিকার হয়ে হতাশা- তাদের এসব শিশুদের এই পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এর কারণ বহুলাংশেই সামাজিক। সমাজ ও রাষ্ট্রকেই দায় নিতে হবে এসব শিশুর নিরাময়ের, তাদের সুপথে আনার, সর্বোপরি সুস্থ্য জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দেয়ার। দুর্ভাগ্যজনক হলো, মাদকাসক্ত পথশিশুদের নিরাময়ে সরকারের উদ্যোগ যা আছে তা নামে মাত্র। কিছু এনজিও এনিয়ে কাজ করলেও কোনো ইতিবাচক ফলাফল এখনো দৃশ্যমান নয়। আর বেসরকারিভাবে বিত্তবানদের টার্গেট করে অনেক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও ছিন্নমূলদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই।
সচেতন মহল মনে করছেন, রাষ্ট্রকেই প্রধানত দায়িত্ব নিতে হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ীও, শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শিশু-কিশোরদের মাদকের ছোবল থেকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন ও সচেতন নাগরিকদেরও দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের চাইল্ড সেফটিনেট প্রজেক্টের কর্মকর্তা সৈকত মজুমদার সৌরভ দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিনকে জানান, পথশিশুদের দিয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশন কাজ করে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে তার সচেষ্ট। তবে মাদকাসক্তদের ভাল করার জন্য বিভিন্ন চাইল্ড কেয়ার তৈরি করা আছে। আমরা তাদেরকে ভাল পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। 

Comments