ইতিহাসের মহানায়ক- মোঃ নূর ইসলাম ফরাজী

ইতিহাসের মহানায়ক 
                                        মোঃ নূর ইসলাম ফরাজী


হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপাল গঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত শেখ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল শেখ লুৎফর রহমান, মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই ছিলেন সাহসী এবং সংগ্রামী। নিজের চোখে দেখেছেন বৃটিশদের শোষণ-নির্যাতন। এর পর পাকিস্তানীদের শোষণ-নির্যাতন, নিপীড়ন। এই শোষণ-নির্যাতন, নিপীড়ন দেখতে দেখতে মানুষের মুক্তির জন্য সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়ে উঠেন সাধারণ থেকে অসাধারণ মহানয়ক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশর স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে ধানমন্ডির ৩২নং বাসায় নিহত হন। স্বাধীনতার পরাজিত শত্র“, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে এ দেশের সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী অফিসার ও জওয়ানদের দ্বারা ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম, বর্বর ও নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করে। এই হত্যাকাণ্ডটি থেকে রেহাই পায়নি তাঁর শিশুপুত্র শেখ রাসেল ও অন্ত:স্বত্ত্বা পুত্র বধূরা, এমনকি তাঁর আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত। অনেক আশা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি উন্নত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠাংশটির যেন পরিসমাপ্তি ঘটলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা যেন অপমৃত্যু ঘটলো। একটি জাতি, একটি দেশ যেন সঠিক পথ চলা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতক চক্রের হাত থেকে মহান আল্লাহর রহমতে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে আমরা একটু পিছনের ইতিহাস আলোকপাত করি। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গান্ধী ও জিন্নাহ ছিলেন বড় মাপের রাজনীতিবিদ। তাঁদের সমপর্যায়ের নেতৃত্ব বাংলায় ছিলনা। পাকিস্তানের ভাষা উর্দু ও ভারতের ভাষা হিন্দি। আমরা বাঙালিদের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেন। এই ভাষাগত বৈষম্যের কারণে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মধ্যে যে ভাষা ভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তৎকালিন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে আবির্ভূত হতে দেখতে পাই। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ঐ জাগরণকে আরো গতিশীল করে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট রূপলাভ করে। এই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৫৮ সনের সামরিক শাসন ও ১৯৬২ সনের শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার রাজনীতি অতিবাহিত হচ্ছিল। এই আন্দোলনের গতি আরো ত্বরান্বিত করে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবী। এই ছয়দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একজন ক্যারিশমেটিক লিডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং বাংলার মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করেন। পূর্ববাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের জুলুম-নির্যাতনের যাঁতাকল থেকে স্বাধীন করার বাসনা শেখ মুজিবুর রহমানের বরাবরই ছিল। এই সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে জেলে বন্দী করা হয়। পূর্ববাংলার ছাত্র রাজনীতির উত্তাল মুহূর্তে ১৯৬৯ সনের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানীদের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি এবং তৎপরিপ্রেক্ষিতে গণ আন্দোলনগুলো পরিচালিত হচ্ছিল। আন্দোলনের এমন একটি ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এই কালজয়ী ভাষণে বাঙালির স্বাধীনতা ও পরবর্তী করণীয় সব কিছুই যেন প্রতিভাত হয়ে উঠলো। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবির মত উচ্চারণ করলেন- “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তাঁর এই ভাষণ আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে আন্দোলিত করে।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বিশ্ব বিবেককে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের পক্ষে আনতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকেই যেন প্রথম আঘাতটি আসে এবং এভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর ’অপারেশন সার্চ লাইট‘ নামক বর্বরোচিত হত্যাকা- চালায়। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে এবং ঐদিন থেকে বাংলাদশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের কাংখিত বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারী মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে তিনি ফেরত পাঠাতে সক্ষম হন এবং বিশ্বমানের একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, ভঙ্গুর, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এই দেশকে তিনি পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। অভ্যন্তরীণ শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশকে অতি দ্রুত জাতিসংঘ, ওআইসি, ন্যামের মত সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত করতে সক্ষম হন। তৎকালিন সমসাময়িক রাষ্ট্র নায়ক জামাল আবদুল নাসের, সুকর্ত, মার্শাল টিটো, ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ বিশ্ব নেতাদের কাতারে নিজেকে দাঁড় করান। এ সময় বাঙালির বঙ্গবন্ধু বিশ্ব বন্ধুতে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে কিউবার নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন ”আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আমি মানুষের হিমালয়কে দেখেছি”। কিছুদিন আগে বিবিসি জরীপে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এতদসত্ত্বেও ১৯৭১ সনের পরাজিত শক্তি ও আন্তর্জাতিক শক্তি তাদের চক্রান্ত বন্ধ করেনি। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তারই স্বজাতিরা চক্রান্তকারীদের প্ররোচনায় ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট সপরিবারে হত্যা করে যার মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসে একটি সম্ভাবনাময় স্বর্ণযুগের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে একটি জাতি সঠিক পথচলা থেকে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রায় ২০ বছর শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যেন ইতিহাসের পাঠে অনুচ্চারিত থেকে যায়।
১৯৯৬ সনের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন এবং বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা যে কলংক দীর্ঘদিন বাঙালী জাতি বহন করে ছিল তা থেকে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়। এতে বাঙালী জাতি দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলা কলংকের দায় থেকে মুক্তি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় এখনো পরিপূর্ণভাবে স¤পন্ন করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করা হবে। এতে করে সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তার দায় কিছুটা হলেও শেষ হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সরকার কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বিশাল সমুদ্র জয় প্রভৃতিতে ব্যাপকভাবে অগ্রগতি সাধন করেছেন। আশা করা যায় অতি অল্প সময়ে এদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। একটি শোষণহীন, দারিদ্রমুক্ত ও আত্ম মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে ওঠবেই। তাই, ১৫ আগষ্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর লালিত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা সফল হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আইফুল স্মৃতি সংঘ, খুলনা।

Comments