বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে তরমুজের বাম্পার ফলন/জয়নাল

বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে তরমুজের বাম্পার ফলন
চিংড়ি চাষীরা ফিরে এসেছে তরমুজ চাষে

তরমুজ চাষে গত একযুগের রেকর্ড সৃষ্টি
বিঘা প্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ

জয়নাল ফরাজী:
বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে এবার তরমুজের বাম্পার ফলনের ফলে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। গতবছর চৈত্রের শুরু থেকে দফায় দফায় ঝড় ও বৃষ্টির কারণে চাষীরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এবার বৃষ্টিপাতের দেখা না হওয়ায় সেই সমস্যা নেই। তবে গাছের মাঝামাঝি বয়সে যে ছিটেফোটা বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল তা না হওয়ায় কৃষকদের সেচ খাতে সামান্য কিছু অতিরিক্ত পুঁজি ব্যয় হয়েছে। তবে গত সপ্তাহে দু’দিন রাতের বেলায় সামান্য বৃষ্টিপাত তরমুজ চাষীদের জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে। তবে চাষীদের আর বৃষ্টিপাত কাম্য নয় আগামী কিছুদিন।  আবহাওয়া আর ১৫ দিন অনুকুলে থাকলে তরমুজ চাষে গত একযুগের রেকর্ড সৃষ্টি হবে বলে কৃষিবিদরা আশা করছেন। 
সূত্রমতে, এ বছর কেবল ৫০ শতাংশ তরমুজ আগাম তোলা হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ তরমুজ মাঠে রয়েছে। কৃষকের দু’ চোখ জুড়ে এ তরমুজকে ঘিরে হাজারও স্বপ্নের তন্তু জালে যেন নিরাশার ছন্দপতন না হয় তা নিয়ে কৃষি সংশ্লিষ্টদেরও উৎকন্ঠা কাটছে না। তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধুই আকুতি সিডর বা আইলার মত কোন দুর্যোগ না হয়। ভয়ংকারী কোন কাল বৈশাখী ঝড় যেন ছোবল না মারে। কেননা সিডর আইলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রাকৃতিক বাগদা পোনার সংকট সহ নানা কারণে চিংড়ি চাষীরা অনেকেই হাত গুটিয়ে পেশা পরিবর্তন করে আবার ফিরে এসেছিল তরমুজ চাষে। গত ৪-৫ বছর ধরে কৃষকরা আমন ধানের শেষে তরমুজ চাষে বিশেষ সফলতা পেয়ে আসছিল। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে বৃহত্তর খুলনার উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ আবার যে কৃষিতে ফিরে আসছে তা নি:সন্দেহে কৃষি বিপ্লবেরই ইঙ্গিত বহন করে। 
সূত্রমতে, বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের শস্য ভান্ডার নামে খ্যাত অঞ্চলগুলোতে এবারও তরমুজের বাম্পার ফলন এর আশা করছে কৃষকরা। চাষীদের মুখে তাই উচ্ছ্বাসের হাসি। বিঘা প্রতি ৫/৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে চাষীরা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে অন্যান্য বছর গুলোতে। এবার আশা আরো বেশি।  এ অঞ্চলের তরমুজ সহজতর ভাবে রপ্তানি হয় খুলনার বাইরে কুয়াকাটা, যশোর, বেনাপোল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, বরিশাল সহ দেশের বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্রীক এলাকায়। তবে আগামীতে সম্ভাবনাময় এ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত দূর্যোগ মোকাবেলা করার মত টেকনিক অবলম্বন করবে বলে জানিয়েছে এলাকাস্থ সংশ্লিষ্ট চাষীরা। 
দূর্যোগ প্রবন উপকুলের শস্য ভান্ডার নামে খ্যাত এ অঞ্চলে এবারও তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং তা শেষ পর্যন্ত চাষীদের মুখে হাসি ফুটাবে বলে আশা করছে কৃষকরা। খুলনার দাকোপ উপজেলার বাজুয়া, কৈলাশগঞ্জ, লাউডোব এলাকা ঘুরে চাষীদের সাথে আলাপ করে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বর্তমান মৌসুমে তরমুজ বিক্রি করে আশানরূপ মুনাফা অর্জিত হবে বলে চাষী পরিবারে নিরাশার মধ্যেও বইছে কিছুটা তৃপ্তির খুশি। যদিও মৌসুমের মাঝ পথে অনাবৃষ্টির কারনে পর্যাপ্ত পানির সংকটে ফসল উৎপাদন কিছুটা ব্যহত হয়। তথাপি বিঘা প্রতি ৫/৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে চাষীরা ২২/২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে সক্ষম হবে বলে কৃষকরা এ আশা করছে। স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় মালামাল পরিবহন খরচ অনেকটা বেশি হয়। এছাড়াও আছে কিছু ছিচড়া চাঁদাবাজদের উৎপাত। পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিকুল পরিবেশের কারনে চাষীরা তাদের উৎপাদিত তরমুজ সরাসরি পাইকারীদের হাতে তুলে দিতে না পারায় কাংক্ষিত মাত্রায় মুনাফা অর্জন সম্ভব হয় না। গরমের মৌসুমে এলাকায় দেখা দেয় তীব্র পানির সংকট। কৃষকদের মুখের বুলি মতে সম্ভবনাময় এখাতকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে মিষ্টি পানি ধরে রাখার সুব্যবস্থা সৃষ্টি করা অপরিহার্য। সাথে সাথে চাষীদের  মাঝে সুদ মুক্ত ঋন প্রদানের দাবী জানিয়েছেন চাষীরা। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে এনজিও ব্র্যাক ব্যাংক কিছু ঋন প্রদান করছে কিন্তু চাহিদার বিপরীতে সেটা নিতান্তই অপ্রতুল এবং যৎসামান্য।
সাতক্ষীরার এলাকার তরমুজ চাষী তুষার গাইন ৩ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে বিক্রয় মৌসুমে বিঘা প্রতি ২৫ হাজার টাকা করে লাভবান হয়েছে বলে জানা যায়। বাগেরহাটের তরমুজ চাষী সাধুরাম সরদার ৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে অনুরুপ লাভবান হয়েছে বলে জানায়। লাউডোব গ্রামের আমিন খন্দকার ১০ বিঘা জমিতে ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করে বর্তমান মৌসুমে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা, পশ্চিম বাজুয়ার চাঁদপাড়া এলাকার তরমুজ চাষী সুপদ রায় জানায় সে ৬ বিঘা জমিতে ৪২ হাজার টাকা ব্যয় করে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার, বেড়েরখাল থেকে তরমুজ চাষী অনিমেষ মন্ডল জানায় সে ৩ বিঘা জমিতে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করে ১ লক্ষ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছে বলে জানা যায়। 
অপরদিকে বাজুয়া কাঁকড়াবুনিয়া ও কচা এলাকার তরমুজ চাষী ইউপি সদস্য দীনবন্ধু মন্ডল জানায়, তাদের চাষকৃত জমি একটু নিচু হওয়ায় পানি জমে তরমুজ গাছের ব্যাপক ক্ষতি সহ ফসল উৎপাদন খুবই ব্যাত হয়েছে। যার ফলে উক্ত এলাকার চাষীরা মূলধন ঘরে তুলতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। হরিণটানার এলাকার বিভূতি স্যার দেড় বিঘায় বিক্রয় করেছে ৩৮ হাজার টাকায়। অনুরুপ লভ্যাংশের কথা স্বীকার করেছেন ওই অঞ্চলের অন্যান্য চাষীরাও। দাকোপের বাজুয়া অঞ্চলের উৎপাদিত তরমুজ রপ্তানি হচ্ছে খুলনা, ঢাকা, বরিশাল সহ দেশের ছোট বড় বিভিন্ন মোকামে। প্রতিদিন শত শত নৌকা ও ট্রলার এসে ভিড় জমে উপজেলার পোদ্দারগঞ্জ ও বাজুয়া গেট, বাজুয়া চড়ারবাঁধ সংলগ্ন এলাকায়। তরমুজ বিক্রির এই মৌসুমে পরিবহন খাতে স্থানীয় পর্যায়ে একটি বড় অংশ জনবল শ্রম বিক্রি করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। পাশাপাশি ইঞ্জিন চালিত ভ্যান ঠেলাগাড়ী চালকরাও আছে জমজমাট ব্যবসার মাঝে। এ ব্যাপারে দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জানা যায় ওই পোল্ডারের ৫ টি ইউনিয়নে ১৩২৬ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষাবাদ করা হয়। উল্লেখিত সমস্যা গুলি নিরসন করলে তরমুজ চাষে এ অঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 
সব মিলিয়ে বলা যায় মৌসুমের এই সময়টাই তরমুজ বিক্রিকে কেন্দ্র করে দাকোপের জনবলের একটি বড় অংশের মাঝে দেখা যায় কর্মচাঞ্চল্য। সংশ্লিষ্ট চাষীরা এ খাতে বড় অংকের পুঁজি বিনিয়োগের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বেসরকারী সাহায্য সংস্থা গুলোর দৃষ্টি আকর্ষন করেছে এলাকাস্থ ভুক্তভুগী চাষীরা। 

Comments