শেখ সাহেব থেকে বাঙালি জাতির পিতা : নূর ইসলাম ফরাজী

‘শেখ সাহেব থেকে বাঙালি জাতির পিতা’

: মো: নূর ইসলাম ফরাজী :


বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানকে নিয়ে মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন এক বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গীর, যা আমার মধ্যে বিদ্যমান নাই। অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে এই মহান নেতার জীবনী বা কর্মকাণ্ড সঠিক মূল্যায়নের দক্ষতা বা যোগ্যতা কোনটাই আমার অর্জন করতে সক্ষম হই নাই, তবুও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মহান নেতাকে নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গী এবং মূল্যায়ন উপস্থাপনের জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন ৷ বঙ্গবন্ধুর শৈশবের কর্মকাণ্ডের ইতিহাস “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইয়ে খুব পরিষ্কার ভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রয়াত সংসদ সদস্য ও লেখিকা বেবি মউদুদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পদনায় বঙ্গবন্ধুর লেখা নিয়ে প্রকাশিত “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”তে জাতির জনকের জীবনের অনেই কিছুই ফুটে উঠেছে। শৈশব থেকে নেতৃত্বের গুণাবলিতে গুনাম্বিত বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের ক্রমবিকাশে এক সময়ে বাঙালির মুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যার নেতৃতে স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে একটি স্কুল পরিদর্শনে আসেন৷ পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং ছাত্রাবাস মেরামতের দাবি জানান অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন। সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সৎ সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন এবং ডেকে নিয়ে ভালবাসায় সিক্ত করেন। এই ছেলেটি আর কেউ নয় পরবর্তীকালের অনেক বিদ্রোহের অগ্রপুরুষ ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহান বাক্য উচ্চারণ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি সোহরাওয়ার্দীকে রাজনৈতিক গুরু বলে স্বীকার করতেন। আর শেরেবাংলা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৪২ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান। তখন থেকেই মুসলীম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান। তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর৷ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্র“পের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হলো৷ বঙ্গবন্ধু তখন ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন এবং কারাবন্দি থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ অক্টোবরে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ যখন উত্তপ্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকেই ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে কারাগারে অনশন অব্যাহত রাখেন। কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্র“য়ারি বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্তির পরে মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী মুসলীম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের ২৫ই জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ১৯৬৬ সালের ১লা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয় এর পূর্বের ২০ মাসও শেখ মুজিব জেলে আটক ছিলেন৷ ১৯৬৯ সালে ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে যখন ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ তখন তৎকালীন সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। মুক্তিলাভ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান সহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি বর্তমান সরকারের শিল্পমন্ত্রী জননেতা তোফায়েল আহমদ সাহেব শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে। ১৯৭১সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রের মঞ্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন যেই ভাষণ বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সেরা ভাষণগুলোর অন্যতম একটি। বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে বঙ্গবন্ধু সেদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন- “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তারপর- “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।” বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের প্রতিটি জনগন ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে এবং তাঁর নির্দেশনায় দীর্ঘ নয় মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানকে ১৯৭১ সালের ২৫ই মার্চ কাল রাতে গ্রেপ্তার করেন পাকিস্তানী বাহিনী, গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যা ২৬ই মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড গোপনে ভারতে চলে যায়। সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে৷ প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহিঃর্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে৷ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে তৎকালীন সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে স্বাধীন বাংলার জমিনে আসেন। বঙ্গবন্ধু দেশে পদার্পণ করেই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের বাস্তব রূপদানের লক্ষ্যে যখন নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তখনই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ক্ষমতালোভী, স্বাধীনতা বিরোধীদের প্ররোচনায় বিপদগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। যেই বাঙালির মুক্তির জন্য জীবনের সোনালী সময়ের অধিকাংশ সময় কারাগারের কোটরে নির্বাসিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই জাতির কিছু কুলাঙ্গার সন্তান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৭২ সালে স্বদেশে ফিরার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা, তাঁদের পরোক্ষ ভাবে মদদ দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তানের অনুগত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর কর্তারা। প্রাথমিক দিকে বঙ্গন্ধুকে বিতর্কিত করতে ষড়যন্ত্রকারীরা বলতেন “বঙ্গবন্ধু একজন সুদক্ষ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কিন্তু সুদক্ষ শাসক ছিলেন না”। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পুত্র বিতর্কিত রাজনীতিবিদ তারেক রহমান বললেন “মুজিব নয় জিয়াই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি” তারেক রাহমানের বক্তব্য রাজনৈতিক মর্মে উল্লেখ করেন উনার দলের সিনিয়র দুই একজন নেতা। বঙ্গবন্ধু ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা গ্রন্থে বিএনপি’র জনক এবং তারেক রহমানের জনক জিয়াউর রাহমান সাহেবের অনেকগুলো বক্তৃতা হুবহু উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে জিয়া কখনোই বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেন নাই এমনকি জিয়ার বক্তব্যে বঙ্গন্ধুকে উনি জাতির পিতা হিসেবে বার বার উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের দিকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের দুই একটি রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করতে নানান রকমের আজগুবি কল্পকাহিনী প্রচার করতেন, স্বাধীনতা বিরোধী দেশগুলোর গোয়েন্দাসংস্থার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে জাতির পিতাকে বিতর্কিত করাই ছিল ক্ষমতালোভী সেই সংগঠনগুলোর প্রধান কাজ। পরবর্তীতে জিয়াউর রাহমান ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী কে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিতে পেরেছেন মর্মে আমার বিশ্বাস। ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তিরা রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে প্রতিশোধ নিতে এবং তাদের অতীত কুকর্ম ঢাকতে নতুন করে বিতর্কে মাত্রা যোগ করেন। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে তাদের কোন বাঁধা ছিল না, নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস বিকৃত করার প্রয়াসে লিপ্ত পরাজিত শক্তি কিছুটা সফলতার সহিত স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে বিতর্কিত করে উদ্দেশ্য হাসিলের মিশনে কিছুটা সফলতার মুখ দেখেছিলেন। যুগে যুগে ইনিয়ে বিনিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্তরা নানান ভেসে নানান পতাকাতলে নিজেদের আবির্ভূত করেছেন, যাদের অন্তর আত্মায় পাকিস্তানের প্রতি প্রীতি রয়েই গেছে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করলেই তাদের সফলতা। যিনি সত্যকে গোপন করে মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে মিথ্যাচার করেন তিনি সত্যটা অবশ্যই জানেন কিন্তু মানেন না। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেন তাঁরা হয়তবা আহাম্মক নতুবা প্রজন্মের সাথে প্রতারক। ইদানীং কালে কেউ কেউ মন্তব্য করেন “ বঙ্গবন্ধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন নেতা”। ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের কর্মী বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাঙালির মুক্তির এক মহানায়কে, একটা রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে বাস্তব রূপ দানের মাধ্যমে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। যারা রাজনীতি করেন নাই, রাজনীতির সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা নেই তাদের মুখেই মানায় বঙ্গবন্ধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বাঙালির মুক্তির এই মহানায়ক যে বিশ্বমানের রাজনীতিবিদ ছিলেন তাঁর উত্তম উদাহরণ দিয়েছেন ৭ই মার্চের ভাষণে। বঙ্গবন্ধু এই দেশের মানুষের অর্থনীতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মুক্তির আন্দোলনকে এক পরিপূর্ণ অবস্থানে এনেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতিবিদ বলেই জনমতকে একই ছাতার নীচে এনে ঘোষণা দিয়েছেন প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ৭ই মার্চের ভাষণে যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নকে হত্যা করতে পারতেন শক্তিশালী পাকিস্তান, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল বলেই আন্দোলন কে নির্দিষ্ট পর্যায়ে এনে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত “শেখ মুজিব” রাজনীতির মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন, হয়েছিলেন জাতির পিতা এবং অবশেষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা থাকলেও মৌলিক ভাবনার মধ্যে দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। সমালোচিত লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার তাঁর সমালোচিত বই “ভিতরে-বাহিরে” এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবমূল্যায়ন করেছেন। আমার ভাবনায় বিমান বাহিনীর কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা উনার বইয়ে উনার দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে গিয়ে মৌলিক বিষয়ে আঘাত হেনেছেন। যেহেতু উনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না সেহেতু রাজনৈতিক নেতার মূল্যায়ন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করতে সামর্থ্য হন নাই। বঙ্গবন্ধু এবং উনার আদর্শের সৈনিকেরা দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক মণ্ডলে রাজনৈতিকভাবে ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন বলেই উনারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছেন। অগ্র হাতের যুদ্ধের সাথে সাথে যে যুদ্ধে জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে হয় তা হয়ত মনে রাখেন নাই খন্দকার সাহেব। সুবিধাবাদী, সুশীল এবং অজ্ঞরা যখন মৌলিক বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার প্রয়াসে মন্তব্য করেন তখন মনে হয় এরা আসলেই নির্বোধ, এরা আসলেই লাইনচ্যুত। অবশেষে বলব বাঙালির মুক্তির পথ প্রদর্শক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান সাহেব কে শুধু নেতা বলার সুযোগ নেই, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, মহান নেতা, তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা ও হাজার বছরেরে শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
(তথ্যসূত্র : ১। বাংলা পিডিয়া। ২ উইকিপিডিয়া। ৩। বঙ্গবন্ধু ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা।)
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আইফুল স্মৃতি সংঘ, সোনাডাঙ্গা, খুলনা।

Comments